Tag: Kolkata

অণু গল্প ৭ – কলমকারি (সুদীপ্ত মাইতি)

পৃথিবীতে কিছু আকর্ষন আছে যা আমার কাছে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল।এ তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে কলম প্রীতি, যা আজকের নেট সর্বস্ব যুগে বেমানান এবং গুরুত্বহীন। তবুও এ প্রেম ছাড়ে কই? মরণ বাঁধনে বেঁধেছে সে আমায়।
সেদিন গেছি ডাক্তার বাবুর চেম্বারে স্ত্রী – কন্যাকে নিয়ে। কন্যা রত্নটি কিঞ্চিৎ অসুস্থ। তার উৎসারিত ক্রন্দনরোল আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
ডাক্তার বাবু খুবই যত্ন সহকারে পরীক্ষা করলেন। তারপর আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ” চিন্তার কিছু নেই। বাচ্ছা ঠিক আছে। ” কিছু ওষুধ লিখে দিলেন রুটিন মাফিক।
স্ত্রীর মুখে ঈষৎ হাসি খেলছে, মাস্ক পরা অবস্থাতেও তা বোঝার অসুবিধা নেই। কিন্তু, আমার কপালের ভাঁজ নেমে এসেছে বুকের ঠিক যেখানটায় ঈর্ষা বাস করে, সেখানেটাতেই। ডাক্তার বাবু দুর্দান্ত একটা ফাউন্টেন পেনে লিখছেন মুক্তোর মতো করে। পাশে আর একটা সযত্নে শুইয়ে রাখা, সেটিও মহার্ঘ। এবং টেবিলের সামনে, আমাদের ঠিক পিছনে কাঁচের শো-কেসটি সুসজ্জিত হয়ে আছে অনেকগুলো বিদেশি নামী কোম্পানির দামী কালির বোতলে। ডাক্তার বাবু এক এক করে ওষুধের নাম ও ডোজ বলেন , আর আমি এক একটা কালির বোতলের ওপরের লেখাগুলো পড়তে থাকি – Pilot, Parker, Sailor, Waterman, Lamy….।

প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ। স্ত্রী কন্যাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন চেম্বার থেকে। আমি আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসি, ” ডাক্তার বাবু, কলমটা কি Sailor? ”
উনি ভাবেন, আমি হয়তো কোনো ওষুধের নাম জানতে চাইছি।
বলেন, ” কোনটা? ”
আমি বলি, ” আপনার কলমটা। ”
বিষ্ময়ের ঘোর কাটতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে শৌখিন ডাক্তার বাবুটির। খানিক ধাতস্থ হয়ে বলেন, ” না এটা Pelikan “।
স্ত্রী ততোধিক বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ফিরে তাকিয়েছেন।

একদিকে ডাক্তার বাবুর বিষ্ময়, অন্যদিকে স্ত্রীর বিরক্তিভরা রাগ – এ দুইয়ের মাঝে নিজের নির্বুদ্ধিতায় বিহ্বল আমি, মুক্তি পেতে তাকাই পরম স্নেহের কন্যাসন্তানের দিকে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা সে যেন ভোরের শিশির ভেজা একমুঠো শিউলি; অপরূপ হাসিভরা সুষমা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার কুন্ঠিত পিতার দিকে। অপার্থিব সে সম্পদের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয় ডাক্তার বাবুর মহামূল্যবান জার্মান Pelikan fountain । রুম ফ্রেশনারের কৃত্রিম গন্ধ সরে গিয়ে চেম্বারে তখন শরত শিউলির সৌরভ।

বুক ভরা শ্বাসে আমার নুয়ে পড়া শরীরটা টান টান হয়ে ওঠে।

উত্তর কথা (সুদীপ্ত মাইতি)

মাঝে মাঝে এমন হয়,
      সময় গড়িয়ে যায় –
      উত্তর দেবার।
মনের ভেতর গুনগুনিয়ে ওঠা
     সুর গুলো খুঁজতে থাকে
কথার দেশের ঠিকানা।
মেঘেরা ভাসতে ভাসতে একদিন
     ফুরায় অশ্রুকণায়।
  গোধূলির লাজুক রঙ লাগে
অভিমানী তারাদের চোখে।
রাত পাখিদের ডানায়
      ছড়িয়ে পড়ে –
গভীর রাতের নিয়ন আলো।

তখনও জেগে থাকে একটি হৃদয়
শিশির ঝরার প্রহর গুনে,
কখন লিখবে তার কবি –
       নিভৃত মনের শব্দ দুটি
       চাঁদের গায়ে গায়ে।

বৃষ্টির গান (সুদীপ্ত মাইতি)

ভবঘুরে মনকেমনের মেঘগুলো, 
   আজ বিকেলে কখন যেন 
বহুদূর অতীতে ফেলে আসা 
   খোয়াব গাঁ- এ-র আকাশ ছুঁয়ে, 
    অন্তহীন ঝরে পড়ল – 
স্মৃতির পাহাড় জুড়ে। 
    বারিধারাপাতে আবছা হয়ে এল 
উদাসী মাঠের বিধূর দিগঞ্চল। 
     তার মানসপটে ফুটে উঠল 
এক ঊজ্জ্বল সাদা – কালো ছবি। 

সেদিনও এমনই বর্ষাঘন বিকেল, 
    মনের খেয়ালে পথ হারিয়ে 
     মেঘের হাত ধরা। 
পাখিরা কবেই ফিরেছে কুলায় 
    বাতাসের পথ চিনে চিনে। 
মুখর বর্ষন মাঝে গাছের দল 
     মৌনী – শান্ত,   সুনিবিড়। 
মেদুর বনপথে বৃষ্টি পায়ে পায়ে 
     হেঁটেছিলাম – তোর পাশে পাশে। 
মেঘ ভেজা মালহারে 
           বিভোর হয়েছিল 
আমার একুশ বছরের আকাশ। 

তারপর… 
কত শ্রাবণ কেঁদে ফিরেছে 
     রিক্তদিনের প্রান্তে। 
আকুল ঝরনার ডাক   
  শূন্য হয়েছে নির্জন বালুপথে। 
তবুও আসেনি বুঝি — উত্তর মেঘ। 

বহু বৃষ্টি হীন শুষ্ক দিনের 
       পথ পার হয়ে, 
আজ সহসা বিদায় বেলায় শুনি – 
    ফিরে এসেছে বুঝি, 
আমার সাধের মেঘমালা। 

           টুপ্   টুপ্   টুপ্  
       ডানা হতে তার ঝরে,  

        মা মা পা  ধা নি, ধা নি… 

ভিজে ওঠে সেদিনের গানখানি।

সম্পর্ক (সুদীপ্ত মাইতি)

বেলা-অবেলার কিছু পরিচয় –
আজও ক্ষনিকের সরণি ছাড়িয়ে,
মেদুর পাকদণ্ডী পথ বেয়ে
ছুঁয়ে ফেলে নিবিড় শিখরদেশ।
গল্পবলা এক বিকেলের হাত ধরে –
মাখে অস্তরাগের আলো,
মূলতানী রঙ নিয়ে খেলা করে
অনন্ত ইছামতীর জল।
একলা মানুষের আকাশে সেদিন –
নামে জ্যোৎস্না রাতের বাদল,
শত ঝিল্লি মুখরিত প্রান্তর
উদার হাত বাড়িয়ে, বলে –

“একা নও বন্ধু, তুমি স্বজন,
পথের পরিচয়ে আমার প্রাণের আপন।”

স্তিমিত শিখার কণ্ঠ (সুদীপ্ত মাইতি)

হঠাৎ ধেয়ে আসা উচকিত স্বরে
                এখন আর চমকে উঠি না,
পরিবর্তে একটা স্বস্তি বোধ হয়, –
                গলা তুলে অস্বস্তি জানান দেবার
শক্তি, তবে এখনো আছে !
                নিঝুম বনানীর গভীর প্রদেশ
সজীব রয়েছে, বোঝার জন্য –
              স্তব্ধতাভেদী এমন গর্জন
মাঝে মাঝে শোনা জরুরি।
              নিস্তরঙ্গ প্রবাহ সচকিত করে
শুশুকের দল মাথা না তুললে,
              জীবন নদীর গতি ধারায় –
প্রাণ খুঁজে পাওয়া ভার।
              বহুপূর্বে, এমন অতর্কিত শব্দ –
আকাশ – মাটি – জল চমকে
            স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ত,
অরণ্যে অরণ্যে দাবানল ঘটাতো।
              আজ বয়সের ছাইয়ে ঢেকেছে
অতীত তেজের সব শিখা।
            তবুও, অঙ্গারের লাল আভায়
বুঝি, আগুনটা এখনো আছে।

Announcements

  • আপনাদের আশীর্বাদে আমাদের এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ অষ্টম বর্ষ অতিক্রম করলো। আমরা আমাদের এই site টি নতুন ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম। আপনাদের মতামত জানান আমাদের email এ (info@amarbanglakobita.com)। বিশদ জানতে contact us menu দেখুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
  • আনন্দ সংবাদ! আমাদের এই site এ এবার থেকে গল্প, অনু গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস প্রকাশিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

Recent Comments

Editorial Choice