Category: Others

পিঁপড়ের রাজত্ব (সন্তোষ রায়)

পিঁপড়ে বলে বাঁচতে হলে
করতে হবে জোট।
কে বা কারা বনের রাজা
ডেকে করো ভোট।
যে বা ভোটে জয়ী হবে
সেইতো বনের রাজা।
অন্যায় পেলে বাঘ হলেও
ধরে দেবো সাজা।
গায়ের জোরে পাহাড়
ভাঙবে এই কখনো হয়?
পেয়েছি মোরা গণতন্ত্র
কীসের করবো ভয়।
বাঘ বলে একি জ্বালা
এবার কোথায় যায়।
পিঁপড়ে দের অত্যাচারে
বনে থাকার উপায় নাই।
আয়-তো যত পশু পাখি
হিংস্র জীব জন্তু।
বনে যত পিঁপড়ে আছে
একে একে গুন তো।
সিংহ বলে মূর্খের মতো
একি বলে বাঘে?
হাতি বলে ঘন জালে
বন টি ঘিরো আগে
ব্যাঙ বলে ভয় নাই
ঢুকে আছি খালে।
গাধা বলে একি কথা
পিঁপড়ে যদি ওঠে ডালে?
টিকটিকি কয় ভয় নাই
ধরে ধরে খাবো।
বলে গিরগিটি কয়টা খাবে
একটুখানি ভাবো।
হনুমান বলে মারবে যদি
আগুন লাগাও বনে
শৃগাল বলে আগুন দিলে
মরবে যে এক-সনে
চিতে কয় মারতে গেলে মরতে হয়
এইতো হলো জ্বালা।
হরিণ বলে এ বন ফেলে
দৌড়িয়ে পালা।

অণু গল্প ১৪ – (সুদীপ্ত মাইতি)

ভালোবাসার যেমন অনেক নাম, আনন্দেরও সেরূপ। কোথায় কোন গিরিগুহার সংকীর্ণ পথ বেয়ে ধেয়ে আসে সে, আর ভেসে যায় ধনীর হর্ম্য প্রাসাদ থেকে দরিদ্রের পর্ণ কুঠির সমান আনন্দের ঝরনা ধারায়, সে খবর কেউ জানে না।  ঊষর জীবন হয়ে ওঠে শস্যশ্যামল, অন্ধকার দিন হয়ে ওঠে আলোময়, সুখহীন প্রাণে হঠাৎ খুশির ঝলকানি। তখন তুমি হয় ভেসে যাও সে স্রোতে তরী হয়ে , নয়তো পাড়ে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকো কুল ছাপানো ঢেউয়ের দিকে।

 

জীবন ধারনের প্রয়োজনে যে সামান্য বৃত্তিটুকু অবলম্বন করি, তাতে বিলাসিতা শব্দটি দূর গ্রহের কাল্পনিক কোনো শব্দ।তাই সত্যিকারের plain living এবং নিস্ফলা high thinking কে সঙ্গী করে দিনতিপাত চলছে।

 

বাড়িতে দ্রুতগামী একটি দু চাকার যান আবশ্যিক – একথা আমাকে অন্তত তিনশো ছাপান্ন জন মানুষ ছাপান্ন হাজারবার বলেছেন। আমারও যে plain living কে সরিয়ে দিতে মন চায়নি তা নয়, তবে ও-ই আয়তকার কালো ব্যাগটির শীর্ণ চেহারার দিকে তাকিয়ে সভয়ে সে চিন্তা ত্যাগ করতে হয়েছে। শেষে অনেক ভেবে, নিজের অর্থনৈতিক বুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে ঠিক করলাম, একটা পুরনো সাইকেল কিনব। গোপন কথা নিজের মনেই রাখতে হয়, নইলে সাফল্যের শতকরা হার নেমে যায়। তাই কাউকেই কিছু না জানিয়ে, এক সন্ধ্যায় নিজের অক্ষমতার লজ্জা অন্ধকারে ঢেকে, বাড়ি ঢুকি একটি হাতবদলী পুরনো সাইকেল নিয়ে। দীন হীনের লজ্জা নিয়ে সে যখন আমার সাথে তার নূতন বাড়িতে প্রবেশ করল, তখন যে অভ্যর্থনা ভেসে এলো তাতে, তার চেয়েও তার নূতন মালিক আরও বেশি নুয়ে পড়ল।

 

কিন্তু, ও-ই যে বললাম – আনন্দ কখন কোথা হতে কিরূপ নিয়ে আসে তা আমরা জানি না। লজ্জার সে অন্ধকার সুতীব্র স্বরে বিদীর্ণ করে  সহসা মঞ্চে আবির্ভূত হল আমার চার বছর বয়সী পুত্র। তার হাততালিতে উড়ল শতেক পায়রা।

 

– বাবা, তুমি সাইকেল নিয়ে এসেছো? এতো বড় সাইকেল!  ও, সামনে একটা ছোট বসার জায়গা!

বাবা, এটা আমি বসব বলে তুমি লাগিয়েছো?

ঠামা, দেখো,  বাবা কি সুন্দর সাইকেল নিয়ে এসেছে।

বাবা, কাল সকালেই তুমি – আমি দুজনে বেড়াতে যাব। আমি সামনে বসব, তুমি চালাবে। কি মজা হবে। খুব আনন্দ হবে…..

 

তার উচ্ছ্বসিত কথার উৎস্রোতে ভেসে যায় পিতার সকল গ্লানি। পরিবারের লোকজনদের উপহাস, বিদ্রূপ  কিছুই তখন কানে আসছে না। গিরিগহ্বরের গোপন প্রান্ত থেকে ধেয়ে এসেছে আনন্দের  বান। ভেসে যাচ্ছে সকল হীনমন্যতার উপল খন্ড। নির্মল, শীতল ধারার মাঝে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে জড়িয়ে ধরি চার বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে। বুঝতে পারিনা, পাহাড়ের বুকে এমন নোনতা জলের বান কোথা হতে এসে আমার দু’গাল  বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

অণু গল্প ৬ – (সুদীপ্ত মাইতি)

প্রতি বছর যেমন হয় – শেষ  পর্বে গিয়ে তাড়াহুড়ো করা, দোকানে যেটুকু জামা কাপড় পড়ে আছে বাজার ঢুঁড়ে তার মধ্যেই পছন্দ করা। এবার পুজোর আগেও তাই, কয়েকটা দিন মাত্র বরাদ্দ বাড়ির সকলের জন্য কেনাকাটা করতে। কাঁধে একটা, আর দুহাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে নিউমার্কেটের সামনে অপরাহ্নের বারট্রাম স্ট্রীটের ভীড় ঠেলে এগোচ্ছি। এক দাদার সঙ্গে দেখা হবার কথা নির্দিষ্ট জায়গায়।  হঠাৎ আবিষ্কার করি হৃৎপিন্ডের কাছে  বাঁদিকের বুকপকেটে  যে স্টীল ব্লু কালারের কলমটি ছিল সেটি উধাও।
মুহূর্তে আশ্বিন শেষের আকশের  অকাল মেঘ আমার মনের আকাশ ছেয়ে ফেলল। হাতে দুব্যাগ ভর্তি শারদীয়ার আনন্দ, তবু মনটা মেঘলা। হতাশার মাঝে নিজেকেই দোষ দিতে থাকি সাধের জিনিসটা পকেটে রাখার জন্য। রাস্তার ভীড় ঘন মেঘের মতো। হাওয়া অফিস বলেছে, সন্ধ্যা থেকেই নামবে শরতের  অকাল বোধনের বৃষ্টি। নিশ্চিত ভাবেই ভীড়ে হারিয়েছে বস্তুটি। মানুষের পায়ের ধূলিতে মলিন হচ্ছে, ঠিকানা হারিয়ে ফেলছে সে।
যাইহোক,  একটু চিনচিনে মন খারাপ নিয়েই দাদার সাথে একটি দোকানে ঢুকি আমার সদ্যোজাত শিশু কন্যার জন্য জামা কিনতে। কন্যার নতুন জামা কিনতে কিনতে ভাবছি, কেমন মানাবে আমার মিঠাইকে। আর বুঝছি, মন ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। সহসা দাদার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে চমকে উঠি।
” পেন পাওয়া গেছে!  “
কোথায় সে? তাকে তো আমি নিজের ভুলে পথের ধুলায় ফেলে এসেছি। তবে কি অন্য কেউ?
প্রবল বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ” কোথায়? “
দাদা আঙুল তুলে দেখান। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখার ধুকপুক নিয়ে তাকিয়ে দেখি, দুহাত ভর্তি আনন্দের ব্যাগের এক কোন থেকে কোমল দুটি ঠোঁটের মাঝখানে ঝকঝকে দাঁতের ঝিলিক!
একি অবিশ্বাস্য ভালোবাসা!  যাকে ফেলে এলাম অযত্নের ধূলিতে, সে কিনা আমারই দরজায় লাজুক বসে রয়েছে প্রেমকে ফিরিয়ে দেবার জন্য !
সযত্নে তুলে নিই তাকে, এনে বসাই নিরাপদ স্থানে।
আমার এ ভালোবাসা অহংকারী ছিল নিজের রূপে। আমার মনের কথা ছুঁয়ে যেত না তাকে।  আজ পথের ধুলায় সকল সাজ ফেলে নিরাভরণা প্রেম আমায় ধরা দিল পরম নিবেদনে।
বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশে মেঘ আরও জমেছে, তবে কোথাও যেন দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে  আনন্দাশ্রু হয়ে –
” হারিয়ে যেতে হবে আমায়, ফিরিয়ে পাব তবে। “

অণু গল্প ৭ – কলমকারি (সুদীপ্ত মাইতি)

পৃথিবীতে কিছু আকর্ষন আছে যা আমার কাছে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল।এ তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে কলম প্রীতি, যা আজকের নেট সর্বস্ব যুগে বেমানান এবং গুরুত্বহীন। তবুও এ প্রেম ছাড়ে কই? মরণ বাঁধনে বেঁধেছে সে আমায়।
সেদিন গেছি ডাক্তার বাবুর চেম্বারে স্ত্রী – কন্যাকে নিয়ে। কন্যা রত্নটি কিঞ্চিৎ অসুস্থ। তার উৎসারিত ক্রন্দনরোল আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
ডাক্তার বাবু খুবই যত্ন সহকারে পরীক্ষা করলেন। তারপর আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ” চিন্তার কিছু নেই। বাচ্ছা ঠিক আছে। ” কিছু ওষুধ লিখে দিলেন রুটিন মাফিক।
স্ত্রীর মুখে ঈষৎ হাসি খেলছে, মাস্ক পরা অবস্থাতেও তা বোঝার অসুবিধা নেই। কিন্তু, আমার কপালের ভাঁজ নেমে এসেছে বুকের ঠিক যেখানটায় ঈর্ষা বাস করে, সেখানেটাতেই। ডাক্তার বাবু দুর্দান্ত একটা ফাউন্টেন পেনে লিখছেন মুক্তোর মতো করে। পাশে আর একটা সযত্নে শুইয়ে রাখা, সেটিও মহার্ঘ। এবং টেবিলের সামনে, আমাদের ঠিক পিছনে কাঁচের শো-কেসটি সুসজ্জিত হয়ে আছে অনেকগুলো বিদেশি নামী কোম্পানির দামী কালির বোতলে। ডাক্তার বাবু এক এক করে ওষুধের নাম ও ডোজ বলেন , আর আমি এক একটা কালির বোতলের ওপরের লেখাগুলো পড়তে থাকি – Pilot, Parker, Sailor, Waterman, Lamy….।

প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ। স্ত্রী কন্যাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন চেম্বার থেকে। আমি আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসি, ” ডাক্তার বাবু, কলমটা কি Sailor? ”
উনি ভাবেন, আমি হয়তো কোনো ওষুধের নাম জানতে চাইছি।
বলেন, ” কোনটা? ”
আমি বলি, ” আপনার কলমটা। ”
বিষ্ময়ের ঘোর কাটতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে শৌখিন ডাক্তার বাবুটির। খানিক ধাতস্থ হয়ে বলেন, ” না এটা Pelikan “।
স্ত্রী ততোধিক বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ফিরে তাকিয়েছেন।

একদিকে ডাক্তার বাবুর বিষ্ময়, অন্যদিকে স্ত্রীর বিরক্তিভরা রাগ – এ দুইয়ের মাঝে নিজের নির্বুদ্ধিতায় বিহ্বল আমি, মুক্তি পেতে তাকাই পরম স্নেহের কন্যাসন্তানের দিকে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা সে যেন ভোরের শিশির ভেজা একমুঠো শিউলি; অপরূপ হাসিভরা সুষমা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার কুন্ঠিত পিতার দিকে। অপার্থিব সে সম্পদের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয় ডাক্তার বাবুর মহামূল্যবান জার্মান Pelikan fountain । রুম ফ্রেশনারের কৃত্রিম গন্ধ সরে গিয়ে চেম্বারে তখন শরত শিউলির সৌরভ।

বুক ভরা শ্বাসে আমার নুয়ে পড়া শরীরটা টান টান হয়ে ওঠে।

বৃষ্টির গান (সুদীপ্ত মাইতি)

ভবঘুরে মনকেমনের মেঘগুলো, 
   আজ বিকেলে কখন যেন 
বহুদূর অতীতে ফেলে আসা 
   খোয়াব গাঁ- এ-র আকাশ ছুঁয়ে, 
    অন্তহীন ঝরে পড়ল – 
স্মৃতির পাহাড় জুড়ে। 
    বারিধারাপাতে আবছা হয়ে এল 
উদাসী মাঠের বিধূর দিগঞ্চল। 
     তার মানসপটে ফুটে উঠল 
এক ঊজ্জ্বল সাদা – কালো ছবি। 

সেদিনও এমনই বর্ষাঘন বিকেল, 
    মনের খেয়ালে পথ হারিয়ে 
     মেঘের হাত ধরা। 
পাখিরা কবেই ফিরেছে কুলায় 
    বাতাসের পথ চিনে চিনে। 
মুখর বর্ষন মাঝে গাছের দল 
     মৌনী – শান্ত,   সুনিবিড়। 
মেদুর বনপথে বৃষ্টি পায়ে পায়ে 
     হেঁটেছিলাম – তোর পাশে পাশে। 
মেঘ ভেজা মালহারে 
           বিভোর হয়েছিল 
আমার একুশ বছরের আকাশ। 

তারপর… 
কত শ্রাবণ কেঁদে ফিরেছে 
     রিক্তদিনের প্রান্তে। 
আকুল ঝরনার ডাক   
  শূন্য হয়েছে নির্জন বালুপথে। 
তবুও আসেনি বুঝি — উত্তর মেঘ। 

বহু বৃষ্টি হীন শুষ্ক দিনের 
       পথ পার হয়ে, 
আজ সহসা বিদায় বেলায় শুনি – 
    ফিরে এসেছে বুঝি, 
আমার সাধের মেঘমালা। 

           টুপ্   টুপ্   টুপ্  
       ডানা হতে তার ঝরে,  

        মা মা পা  ধা নি, ধা নি… 

ভিজে ওঠে সেদিনের গানখানি।

Announcements

  • আপনাদের আশীর্বাদে আমাদের এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ অষ্টম বর্ষ অতিক্রম করলো। আমরা আমাদের এই site টি নতুন ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম। আপনাদের মতামত জানান আমাদের email এ (info@amarbanglakobita.com)। বিশদ জানতে contact us menu দেখুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
  • আনন্দ সংবাদ! আমাদের এই site এ এবার থেকে গল্প, অনু গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস প্রকাশিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

Recent Comments

Editorial Choice